Edit Content

বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন গল্পের পেছনের রাজনীতি কি?

Share the News

সম্প্রতি ভারতীয় মিডিয়া এবং কিছু রাজনৈতিক নেতার পক্ষ থেকে বাংলাদেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে ব্যাপক নির্যাতনের অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। এসব অভিযোগ ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের একটি পরিকল্পিত কৌশলের অংশ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, যার উদ্দেশ্য ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করা এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করা। ঘটনার বিস্তারিত পর্যালোচনা, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট একটি ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে—যা ধর্মীয় নির্যাতনের সরলীকৃত কাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করে এবং অঞ্চলের রাজনৈতিক জটিলতার চিত্র তুলে ধরে।

২০ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে, ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ‘দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ এবং ‘রিপাবলিক টিভি’সহ অন্যান্য ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে সংবাদ শিরোনাম হন। শাহ দাবি করেন যে বাংলাদেশে হিন্দুদের ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে পরিকল্পিতভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। শাহের বক্তব্য ছিল তার একটি বিস্তৃত বক্তৃতার অংশ, যেখানে তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করেছেন এবং তার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির সুরক্ষা নিশ্চিত করার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে যে মুসলিম জনতা হিন্দু মন্দির ও বাড়িতে আক্রমণ করেছে।

এই মন্তব্যকে সমর্থন করেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, যিনি আগ্রায় বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলার পুনরাবৃত্তি করেন। যোগীর বক্তব্য ভারতীয় জনতাকে হিন্দু ভুক্তভোগিতা সম্পর্কে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে ছিল, বিশেষ করে ভারতের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে। তবে, এসব ঘটনা ও তাদের ঘটনার বৃহত্তর প্রেক্ষাপটের বিস্তারিত পর্যালোচনা একটি ভিন্ন কাহিনী তুলে ধরে। ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও মিডিয়া এসব ঘটনাকে একটি বৃহত্তর বিরোধী-হিন্দু প্রচারণার অংশ হিসেবে চিত্রিত করেছে, কিন্তু বাংলাদেশে বাস্তবতা একটি আরও জটিল চিত্র উপস্থাপন করে।

প্রকৃত বাস্তবতা

বিশ্বস্ত বাংলাদেশি সূত্রের প্রতিবেদন, যেমন ‘দ্য ডেইলি স্টার’ এবং ‘প্রথম আলো’, পরিস্থিতির একটি আরও সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সহিংসতা দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সরকারের পতনের সাথে।

যেমন, ১০ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে চট্টগ্রামে হিন্দু ব্যবসায়ী সুব্রত রায়কে আক্রমণ করা হয়। দ্য ডেইলি স্টার-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, রায় একজন প্রাক্তন আওয়ামী লীগ নেতার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন, যিনি জমি দখল ও চাঁদাবাজির জন্য পরিচিত। রায়ের ওপর আক্রমণ স্থানীয় প্রতিশোধের অংশ হিসেবে দেখা হয়েছে, যারা আগের সরকারের দুর্নীতির সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করেছে।

এমনিভাবে, খুলনায়, অন্য একটি হিন্দু ব্যক্তি, অনিল কুমার দাস, ১২ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে আক্রমণের শিকার হন। প্রথম আলো-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দাস আওয়ামী লীগ রাজনীতিবিদদের আশ্রয়ে বেআইনি কার্যকলাপে জড়িত ছিলেন। এসব ঘটনা ধর্মীয় ঘৃণার দ্বারা উত্সাহিত ছিল না, বরং পূর্ববর্তী সরকারের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে প্ররোচিত আক্রমণ ছিল।

একটি পৃথক ঘটনায়, স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রভাবিত একটি হিন্দু গ্রুপ একটি হিন্দু মন্দিরে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করে, মুসলিম মৌলবাদী সহিংসতার একটি কাহিনী তৈরি করতে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জনতার দ্বারা ধরা পড়ে এবং স্বীকারোক্তি ও ভিডিও সামাজিক মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে, যা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করার চক্রান্ত প্রকাশ করে।

হিন্দু মন্দির রক্ষায় বাংলাদেশি মুসলিমদের ভূমিকা

ভারতীয় রাজনীতিবিদদের দাবির বিপরীতে, বাংলাদেশি মুসলিমদের অনেক উদাহরণ রয়েছে যারা এই অস্থির সময়ে হিন্দু মন্দির রক্ষার জন্য সক্রিয়ভাবে উদ্যোগ নিয়েছে। এসব উদ্যোগ সাম্প্রদায়িক সঙ্গতি বজায় রাখার প্রতি প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করে এবং যে ন্যারেটিভ তুলে ধরতে চায় যে বাংলাদেশ ধর্মীয় নির্যাতনের কেন্দ্রবিন্দু, তা মোকাবেলা করে। যেমন, ঢাকা শহরে, মুসলিম ছাত্র এবং নেতারা হিন্দু মন্দির এবং গির্জা রক্ষায় সক্রিয়ভাবে নিরাপত্তা গ্রুপ গঠন করেছেন। এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য একটি প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে এবং উত্তেজনা সৃষ্টির প্রচারণাকে প্রতিহত করে।

অন্যদিকে, জামাত-ই-ইসলামীর নেতৃবৃন্দও হিন্দু মন্দিরে কোনো আক্রমণকে কঠোরভাবে নিন্দা করেছেন এবং তাদের ছাত্র শাখাগুলিকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করেছেন। এটি একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রদর্শন করে যা মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘটনার সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা প্রতিহত করতে কাজ করে।

প্রোপাগান্ডা মেশিন

ভারতীয় রাজনীতিবিদ এবং মিডিয়া যে ন্যারেটিভটি প্রচার করছে যে এসব আক্রমণ একটি বৃহত্তর বিরোধী-হিন্দু প্রচারণার অংশ, তা একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডার অংশ হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশে সহিংসতাকে ধর্মীয় নির্যাতন হিসেবে চিত্রিত করে, অমিত শাহ এবং যোগী আদিত্যনাথ তাদের ঘরোয়া ন্যারেটিভকে শক্তিশালী করতে পারছেন, যা ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আদর্শের কেন্দ্রবিন্দু। এই ন্যারেটিভ ভারতীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে তাদের সমর্থন ভিত্তি শক্তিশালী করতে সহায়ক।

ভারতীয় মিডিয়ার এই ন্যারেটিভ প্রসারিত করার ভূমিকা উপেক্ষা করা যায় না। ‘জি নিউজ’ এবং ‘রিপাবলিক টিভি’-এর মতো সংস্থাগুলি, তাদের চাঞ্চল্যকর কভারেজের জন্য পরিচিত, এই অযাচিত দাবি ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছে। সাংবাদিকতার সততার অভাব মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ানোর জন্য সহায়ক হয়েছে, যা ভারত এবং বাংলাদেশ উভয়কেই প্রভাবিত করছে।

ভুল তথ্যের ভূমিকা

ভুয়া খবর এবং পরিবর্তিত ভিডিওর প্রলোভন যুক্ত হচ্ছে। সহিংসতার পর, বাংলাদেশে হিন্দুদের বর্বরতার দৃশ্য দেখানোর দাবি করা বেশ কিছু ভিডিও ও ছবি ভাইরাল হয়েছে। তবে, ‘অল্ট নিউজ’ এবং ‘বুম লাইভ’-এর মতো ফ্যাক্ট-চেকিং সংগঠনগুলি এই দাবিগুলির অনেকটাই ভুল প্রমাণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকায় হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসের দাবি করা একটি ভিডিও আসলে ভারতীয় একটি ঘটনার ছিল যা বছর কয়েক আগে ঘটে।

এই মিথ্যা তথ্যের ঢল সত্যের উদয়কে কঠিন করে তোলে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য আসল গতি বোঝা কঠিন করে দেয়। এটি সেই সকল ব্যক্তিদের জন্যও অস্ত্র সরবরাহ করে যারা এই ঘটনাগুলিকে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চায়।

বাংলাদেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সহিংসতাকে ধর্মীয় নির্যাতন হিসেবে চিত্রিত করা একটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রকৃত তথ্য বিকৃত করা হয়েছে। বিশ্বস্ত বাংলাদেশি সূত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই আক্রমণগুলি প্রাক্তন আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতির সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে উত্সাহিত প্রতিশোধমূলক আক্রমণ ছিল। ভারতীয় রাজনীতিবিদ এবং মিডিয়া এসব ঘটনাকে তাদের নিজস্ব হিন্দু ভুক্তভোগিতার ন্যারেটিভকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ব্যবহার করছে, যা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক।

এই পরিস্থিতি সংবাদ প্রতিবেদন এবং রাজনৈতিক বিবৃতির সাবধানী ও সমালোচনামূলক বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে, বিশেষ করে যখন এগুলি ধর্মীয় সহিংসতার মতো সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত আগ্রহী পক্ষদের দ্বারা প্রবর্তিত ন্যারেটিভগুলি মুখস্থ গ্রহণ না করে, বরং এসব ঘটনার পেছনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বোঝার চেষ্টা করা।

এই তথ্যানুসারে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এমন একটি আলোচনা প্রসারিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা কেবল সারফেসের গণ্ডি পার করে এবং মৌলিক রাজনৈতিক ও সামাজিক গতিশীলতা সমাধানের চেষ্টা করে যা এসব সংঘাতের জন্ম দেয়। শুধুমাত্র এমন একটি দৃষ্টিকোণই এই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি ও পারস্পরিক বোঝাপড়া প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।