Edit Content

১৯৭১ সালে নিয়াজীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ওসমানীর অনুপস্থিতি নিয়ে রহস্য | গোলাম আহাদ

Share the News

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বদানকারী জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী ১৯৭১ সালে হারানো পাকিস্তানি বাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না, যা একটি রহস্য।

নিয়াজী আনুষ্ঠানিকভাবে তার অস্ত্র মিত্রবাহিনীর কমান্ডার জগজিৎ সিং অরোরার কাছে হস্তান্তর করেন এবং ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান, যা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামে পরিচিত, আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন।

কিন্তু যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ওসমানীর অনুপস্থিতি কিছু প্রশ্ন তোলে এবং এটি আজও একটি রহস্য হয়ে আছে—আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানটি কি ভারতীয় কমান্ডাররা ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের পাশ কাটিয়ে পরিকল্পনা করেছিলেন?

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ এ কে খন্দকার আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, তবে তার ভূমিকা খুব নগণ্য ছিল এবং তাকে কোনো বড় ভূমিকায় দেখা যায়নি।

আসলে, বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বিভিন্ন পক্ষের কাছে বিভিন্ন অর্থ বহন করে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে এটি মাতৃভূমিকে পাকিস্তানি নিপীড়ন থেকে মুক্ত করার বিজয় ছিল। কিন্তু ভারতের কাছে এটি উপমহাদেশের আরেকটি অঞ্চলকে তাদের প্রভাবাধীন করার একটি মাধ্যম ছিল।

ওসমানী আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কেন উপস্থিত ছিলেন না, তার কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই। ওসমানীর উইকিপিডিয়া পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, “১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ওসমানী ঢাকায় ছিলেন না। সিলেট থেকে তার হেলিকপ্টারটি গুলিবিদ্ধ হয়ে মাঝ আকাশে দুর্ঘটনায় পড়ে এবং একটি মাঠে ক্র্যাশ ল্যান্ড করে।”

সিলেট অঞ্চল, যা দুই দিন আগেই মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এসেছিল, সেখানে কে বা কারা ওসমানীর হেলিকপ্টারে গুলি চালিয়েছিল তা স্পষ্ট নয়।

ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ দলিলে পাকিস্তানি এবং ভারতীয় কমান্ডারদের স্বাক্ষর ছিল, কিন্তু মুক্তিবাহিনীর কোনো প্রতিনিধির স্বাক্ষর ছিল না। ওসমানী যদি সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিধিত্ব করতেন, এটি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন পক্ষ হিসেবে প্রদর্শন করত, যে দেশটি নিজের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিল।

আত্মসমর্পণ দলিলের তিনটি প্যারাগ্রাফ বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, পাকিস্তানি বাহিনী যেন ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে এবং ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।

কিন্তু বাস্তবতায় তখন পুরো দেশ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল।

আত্মসমর্পণ দলিলের দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফে উল্লেখ রয়েছে: “এই দলিলে স্বাক্ষরের পর থেকে পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার আদেশ অনুযায়ী পরিচালিত হবে। আদেশ অমান্য করাকে আত্মসমর্পণের শর্ত লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য করা হবে এবং তা যুদ্ধের প্রচলিত আইন অনুযায়ী মোকাবিলা করা হবে। আত্মসমর্পণ শর্তাবলীর অর্থ বা ব্যাখ্যা নিয়ে কোনো সংশয় দেখা দিলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।”

দলিলের তৃতীয় এবং শেষ প্যারাগ্রাফে উল্লেখ করা হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশের কেউ নয়, ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের নিরাপত্তা এবং সম্মানের নিশ্চয়তা দিয়েছে।

“লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা একটি গৌরবময় আশ্বাস দেন যে, আত্মসমর্পণকারী সেনাদের সম্মান এবং মর্যাদা দেওয়া হবে, যা জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী সৈন্যদের প্রাপ্য। এছাড়াও সমস্ত পাকিস্তানি সামরিক এবং আধাসামরিক বাহিনী এবং অন্যান্য বিদেশি নাগরিক, জাতিগত সংখ্যালঘু এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ভারতীয় বাহিনী প্রদান করবে।”

ওসমানীর উপস্থিতি এবং তার স্বাক্ষর ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে সম্পূর্ণতা আনতে পারত। উপরন্তু, তার অনুপস্থিতি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।