গুম বিষয়ক তদন্ত কমিশন ঢাকায় ও চট্টগ্রামে বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থার পরিচালিত আটটিরও বেশি গোপন বন্দিশিবির চিহ্নিত করেছে।
সত্য উদ্ঘাটন শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), এবং কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)-এর মতো সংস্থাগুলি দেশব্যাপী এসব কেন্দ্র পরিচালনা করেছে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মাইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের কমিশন শনিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের কাছে জামুনা রাজকীয় অতিথিশালায় প্রতিবেদনটি হস্তান্তর করেন।
প্রাথমিক তদন্তে কমিশন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের, বিশেষ করে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে। এছাড়া, জাতীয় টেলিকম মনিটরিং সেন্টারের সাবেক মহাপরিচালক বরখাস্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান এবং সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম ও মো. হারুন-অর-রশিদেরও জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, কিছু গোপন বন্দিশিবির এখনও সচল থাকলেও অনেক কেন্দ্র ধ্বংস করা হয়েছে। কমিশন ঢাকায় ও চট্টগ্রামে বারোটি নিরাপত্তা সংস্থার কার্যালয় পরিদর্শন করে আটক কক্ষ, জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ, এবং প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। তবে তদন্তের সুরক্ষার জন্য এসব কেন্দ্রের বিস্তারিত তথ্য এখনো প্রকাশ করা হয়নি।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, ডিজিএফআই, সিটিটিসি, ডিবি, র্যাবের বিভিন্ন ইউনিট, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার, এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা বিভাগের চট্টগ্রাম শাখাসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের পরিদর্শন সম্পন্ন হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সামরিক বাহিনী পরিচালিত কেন্দ্র এবং বেসামরিক বাহিনী পরিচালিত কেন্দ্রের নির্যাতনের কৌশলে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে।
বেসামরিক বাহিনী পরিচালিত কেন্দ্রে (যেমন ডিবি ও সিটিটিসি) নির্যাতন দৈনন্দিন কার্যক্রমের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, সামরিক বাহিনী পরিচালিত কেন্দ্রে নির্যাতনের জন্য বিশেষ শব্দরোধী কক্ষ এবং যান্ত্রিক সরঞ্জামের ব্যবস্থা রয়েছে।
কমিশন কয়েকটি ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনার উদাহরণ তুলে ধরেছে। ২০১০ সালে এক ব্যক্তিকে র্যাব ধরে নিয়ে গিয়ে তার ঠোঁট সেলাই করে, যেখানে কোনো ব্যথানাশক ওষুধ ব্যবহার করা হয়নি। আবার ২০১৮ সালে আরেক ব্যক্তিকে র্যাবের কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে তাঁর কান ও যৌনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। এসব ঘটনা নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মধ্যে নির্যাতনের প্রাতিষ্ঠানিক এবং পদ্ধতিগত প্রকৃতি নির্দেশ করে।
এ পর্যন্ত কমিশন ১,৬৭৬টি গুমের অভিযোগ নথিভুক্ত করেছে, যার মধ্যে ৭৫৮টি ইতোমধ্যেই যাচাই করা হয়েছে। তারা ধারণা করছে, দেশে গুমের মোট সংখ্যা ৩,৫০০ অতিক্রম করবে। প্রতিবেদনে র্যাব ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে এবং নির্যাতনের মূল কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক কারণগুলো সমাধানের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
কমিশন মার্চ মাসে একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন প্রকাশের পরিকল্পনা করেছে এবং আগামী এক বছরের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করার লক্ষ্য নিয়েছে।