Edit Content

ফারাক্কা বাঁধ ব্যবস্থাপনা: আঞ্চলিক পানি সহযোগিতার জরুরি আহ্বান

Share the News

ভারত সম্প্রতি ফারাক্কা বাঁধের ১০৯টি গেট খোলার ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে মারাত্মক বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ভারতের বিহার ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়, বিশেষত রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং কুষ্টিয়াতে বন্যার পরিস্থিতিকে আরও প্রকট করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভারত এ সিদ্ধান্তকে বাঁধ রক্ষার জন্য একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে দেখালেও, এই পরিস্থিতি দ্বিপাক্ষিক পানি ব্যবস্থাপনায় আরও সহযোগিতাপূর্ণ ও স্বচ্ছ নীতির প্রয়োজনীয়তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।

তাৎক্ষণিক ঝুঁকি

বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি ২০২৪ সালের ২৬ আগস্ট ফারাক্কা বাঁধের গেটগুলো খোলার ভারতের সিদ্ধান্তের মূল কারণ ছিল অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে বাঁধে সঞ্চিত পানির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা। দ্য মিরর এশিয়া এবং নিউজ ১৮ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, পানির মুক্তির ফলে ১১ লাখ কিউসেক পানি বাংলাদেশে প্রবাহিত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, যা একাধিক জেলা প্লাবিত করার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এর পাশাপাশি, এর আগে ত্রিপুরার ডুম্বুর বাঁধ খোলার ফলে চলতি মাসের শুরুতে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিধ্বংসী বন্যা ঘটে, যেখানে ২০ জন নিহত হয় এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ভারত দাবি করেছে যে, তারা পানির মুক্তি সম্পর্কে আগাম বাংলাদেশকে তথ্য দিয়েছিল, তবে বন্যার তীব্রতা এই যোগাযোগের পর্যাপ্ততা ও সময়োপযোগিতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছে। সব গেট খোলার তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত, যদিও বাঁধের কাঠামোগত ক্ষতি এড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় ছিল, বাংলাদেশের সামনে একটি তীব্র ঝুঁকি তৈরি করেছে, যেখানে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়াই দেশটি ব্যাপক বন্যার সম্মুখীন হচ্ছে।

ভারতের অবস্থান

অস্বীকার ও খর্বকরণ ভারত সরকারের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল ফারাক্কা বাঁধ খোলার সঙ্গে বাংলাদেশের বন্যার কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, জয়সওয়াল বাংলাদেশি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোকে “তথ্যগতভাবে ভুল” বলে উল্লেখ করেছেন এবং পরিস্থিতিকে ভীতিপ্রসূত ও বিভ্রান্তিকর বলে অভিহিত করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে ফারাক্কা বাঁধ একটি পানি নিয়ন্ত্রণ কাঠামো, এটি কোনও বাঁধ নয়, যেখানে পানির একটি অংশ ফারাক্কা খালে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং বাকি পানি গঙ্গা/পদ্মা নদী ব্যবস্থা দিয়ে স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হয়।

যদিও বাঁধটি একটি পানি নিয়ন্ত্রণ সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়, বাংলাদেশের বন্যার সঙ্গে এর কার্যক্রমের সম্পর্ক অস্বীকার করা উপরের দিক থেকে পানির বড় আকারের মুক্তির প্রভাবগুলিকে উপেক্ষা করে। গঙ্গা অববাহিকার জটিল পানিবিদ্যুৎ ব্যবস্থা এবং বাংলাদেশের ইতোমধ্যেই চাপযুক্ত পানি অবকাঠামো এই ধরনের বড় পানি পরিবর্তনের প্রভাবগুলোকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলতে পারে।

যৌথ পানি ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা

ভারতের উজানে নেওয়া পানি ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্তে প্রায়ই বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে, যা দু’দেশের মধ্যে আরও সহযোগিতামূলক পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তাকে সামনে নিয়ে আসছে। ভারত-বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) যৌথ পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তবে বর্তমান পরিস্থিতি এই কাঠামোর কার্যকারিতার সীমাবদ্ধতাকে নির্দেশ করছে। ভবিষ্যতে এমন দুর্যোগ এড়াতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয় ব্যবস্থার উন্নতি করা অত্যন্ত জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে:

  • রিয়েল-টাইম তথ্য বিনিময়: উভয় দেশের মধ্যে একটি রিয়েল-টাইম তথ্য বিনিময় ব্যবস্থা স্থাপন করা, যা উভয় পক্ষের কর্তৃপক্ষের জন্য পানি স্তর, বৃষ্টিপাত এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পর্যবেক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এই ব্যবস্থা স্বচ্ছ এবং উভয় দেশের জন্য প্রবেশযোগ্য হওয়া উচিত।
  • যৌথ বন্যা ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা: উভয় দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে যৌথ বন্যা ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। এসব পরিকল্পনায় বাঁধের গেট খোলার প্রোটোকল অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত, যাতে ভাটির দিকে অবস্থিত সম্প্রদায়গুলোকে পর্যাপ্তভাবে সতর্ক এবং প্রস্তুত রাখা যায়।
  • অবকাঠামোগত বিনিয়োগ: উভয় দেশের সীমান্তে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও বন্যার প্রভাব কমানোর জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে বাঁধ শক্তিশালীকরণ, ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নতি এবং বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ।
  • পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন: বাঁধ বা অন্য কোনও বড় পরিবর্তন আনার আগে পর্যাপ্ত পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন করা উচিত। এই মূল্যায়নে উজান ও ভাটির প্রভাব এবং উভয় দেশের বিশেষজ্ঞদের মতামত অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত।

ফারাক্কা বাঁধের গেট খোলা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, যৌথ পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা একটি সুসংবদ্ধ ও সুষম পদ্ধতির উপর নির্ভর করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমবর্ধমান প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আরও শক্তিশালী, সহযোগিতামূলক পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন আগের চেয়ে অনেক বেশি। উভয় দেশ একত্রে কাজ করে যোগাযোগ, পরিকল্পনা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে ভবিষ্যতে বন্যার ঝুঁকি কমাতে পারে এবং গঙ্গা অববাহিকাকে লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য একটি জীবনদায়ী সম্পদ হিসেবে সংরক্ষণ করতে পারে।